Monday, July 18, 2016

অষ্টাদশ মহাপুরাণ সমগ্র



  1. শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ (পদ্যানুবাদউপেন্দ্র চন্দ্র মিত্র)
    • ০১. ভাগবত পুরাণপ্রথম স্কন্ধ
  2. ০২. পদ্ম পুরাণ
    • ভুমি খণ্ড (পদ্মপুরাণ)
    • স্বর্গ খণ্ড (পদ্মপুরাণ)
  3. ০৩. বিষ্ণু পুরাণ
    • ০১. বিষ্ণু পুরাণপ্রথম অংশ
  4. ০৪. শিব পুরাণ (বৃহৎ)
    • ০১. জ্ঞানসংহিতা
  5. ০৫. শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ (শ্যামপদ ন্যায়ভূষণ)
    • মহাভাগবত পুরাণ০১ম খণ্ড
  6. ০৬. নারদ পুরাণ (বৃহৎ)
  7. ০৭. মার্কণ্ডেয় পুরাণ
  8. ১০. ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ
    • ০৪. কৃষ্ণ-জন্ম খণ্ড
  9. ১১. লিঙ্গ পুরাণ
    • ০১. পূর্ব্বভাগ
  10. ১২. বরাহ পুরাণ
  11. ১৩. স্কন্দ পুরাণ (বৃহৎ) 
    • ০১. মহেশ্বর খণ্ড
      • ০১. কেদার খণ্ড
  12. ১৪. বামন পুরাণ (বৃহৎ)
  13. ১৬. মৎস্য পুরাণ 
  14. ১৭. গরুড় পুরাণ
    • পূর্ব খণ্ড (গরুড় পুরাণ)
  15. ১৮. ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ (বৃহৎ)
    • ০২. উত্তরখণ্ডরাধাহৃদয়

শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ (পদ্যানুবাদউপেন্দ্র চন্দ্র মিত্র)

পয়ার ত্রিপদী ছন্দে শ্রীমদ্ভাগবত মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত মূল সংস্কৃতের পদ্যানুবাদ উপেন্দ্র চন্দ্র মিত্র কর্ত্তৃক বিরচিত

০১. ভাগবত পুরাণপ্রথম স্কন্ধ

০১. অথ শৌনকাদি ঋষিগণের প্রতি ভাগবত বিষয়ক প্রশ্ন

হরিক্ষেত্র মাঝে খ্যাত নৈমিষ কাননে
হরি লভিবারে যত মহামুনিগণে।।
সহস্র বৎসর যজ্ঞ করেন হরষে।
বুঝিতে যজ্ঞের মায়া প্রকৃতির বশে।।
শৌনকাদি মুনি তথা আনন্দিত মনে।
শুনেন শাস্ত্রের কথা সূতের বদনে।।
বেদাদি ভারত কথা অমৃতের সার।
প্রকাশিতে স্তব ঋষি বুদ্ধির আগার।।
একদা প্রভাত লো তিমির শর্ব্বরী।
জাগিল যতেক ঋষি নিদ্রা পরিহরি।।
সাধিয়া যজ্ঞের কর্ম্ম যত ঋষিজন।
জিজ্ঞাসে সূতেরে তবে করি অভ্যর্থন।।
হে সূত তোমার মুখে শাস্ত্র আলাপন।
শুনিয়া সার্থক লো মোদের জীবন।।
স্বগুণ নির্গুণ ব্রহ্ম কহে সর্ব্বজনে।
ব্যাসাদি প্রবল বুদ্ধি করে আলোচন।।
সকল শাস্ত্রের মর্ম্ম ব্যাসের ভারতী।
শুনিয়াছ তুমি সূত করি স্থিরমতি।।
বিষম প্রমাদ বশে আমরা সকলে।
না জানি নির্গুণ ব্রহ্ম ব্রহ্মমায়া বলে।।
কহ আয়ুষ্মান্ক্রমে ভাগবত সার।
যাহাতে হইবে মুক্ত ঘোর সংসার।।
কলিযুগে অল্পবুদ্ধি যতেক মানব।
অল্পায়ু অলস হবে পাপে রত সব।।
কেমনে সংসার তে হইবে উদ্ধার।
কহ সূত সে সংবাদ সর্ব্ব সারাৎসার।।
আগম নিগম বেদ তন্ত্র ইতিহাস।
সকলি আছয়ে সূত ব্রহ্মার আভাস।।
অল্পায়ু মানব যবে কলিতে জন্মিবে।
জলধি সমান শাস্ত্র কেমনে বুঝিবে।।
কৃপা করি ওহে সূত কহ সেই বাণী।
সর্ব্বশাস্ত্র সার কথা যাছে তরে প্রাণী।।
ভক্তের পালন কর্ত্তা সেই ভগবান।
দেবকীর গর্ভে জন্মি কেন দেহবান।।
কাহার মঙ্গল হেতু ত্যজি দেবদেহ।
উদিলেন সংসারে ছাড়ি স্বর্গগেহ।।
কর সেই ইতিহাস হে সূত! বর্ণন।
যা শুনি জীবের হবে মঙ্গল সাধন।।
শুনিয়াছি নারায়ণ ভুবন ভিতরে।
অবতাররূপে আসি সর্ব্বদুঃখ হরে।।
কঠিন মানব যদি কভু কায়মনে।
ডাকেনারায়ণবলি জিনে পাপগণে।।
ভবের বন্ধন তায় ছিন্ন য়ে যায়।
সেইক্ষণে সেই নর মুক্তিপদ পায়।।
আছয়ে যতেক ভয় সংসার বন্ধনে।
সকলেই কম্পান্বিতা শুনি নারায়ণে।।
নারায়ণে যেই ঋষি সঁপিয়াছে প্রাণ।
যথায় উদয় তাঁর পবিত্র সে স্থান।।
যথা গঙ্গাবারি বিনা শুদ্ধি নাহি হয়।
হরিনাম বিনা তথা দেহ শুদ্ধ নয়।।
দারুণ কর্ম্মের ভয়ে যদি কোনজন।
ইচ্ছা করে ত্যজিবারে কর্ম্মের ভুবন।
হরিনাম বিনা আর নাহি অন্যগতি।
হরিযশঃ না গাহিলে নহে শুদ্ধ মতি।।
দেখহ প্রমাণ তার নারদাদি মুনি।
হরিগানে পূণ্যবান পুরাণেতে শুনি।।
হরিনাম শুনিবারে আমরা সকলে।
হইয়াছি অভিলাষী কহ পূণ্যবলে।।
লীলাক্রমে ভুবনে সেই নারায়ণ।
যেইরূপে অবতার করহ কীর্ত্তন।।
তৃপ্ত নাহি মোরা প্রভু নামমাত্র শুনি।
কহ তাঁর ইতিহাস ওহে মহামুনি।।
অজ্ঞান আঁধার যাহে হয় দূরীভূত।
জ্ঞানময় ব্রহ্মবুদ্ধি যাহে মূলীভূত।।
সেই কথা সাধুজন করেন শ্রবণ।
কহ কহ ওহে সূত সেই বিবরণ।।
বসুদেব পিতা বলি কেমনে কেশব।
প্রকাশিলা নিজ লীলা ব্যাপিয়া ভব।।
কলিরে আসিতে হেরি সংসার ভিতরে।
হইয়াছি অভিলাষী হরি জানিবারে।।
বিষ্ণু লাগি এই ক্ষেত্র এই যজ্ঞস্থল।
সমাগত এই যজ্ঞে মুনীন্দ্র সকল।।
শুনিতে হরির কথা সকলের মন।
কহ সূত ব্রহ্মময় হরি বিবরণ।।
ভকত বৎসল হরি সেই নারায়ণ।
শুনাইতে সেই কথা তব আগমন।।
ধর্ম্মের আধার কৃষ্ণ ত্যজিয়া সংসার।
বৈকুণ্ঠেতে তিরোভাব লেন আবার।।
কহ সূত ধর্ম্ম এবে থাকিয়া ভুবন।
কাহারে আশ্রয় ভাবি করিল স্মরণ।।
উপেন্দ্র রচিল গীত হরি আশা করি।
ভাবহ সংসারবাসী ব্রহ্মময় হরি।
ইতি ঋষি প্রশ্ন সমাপ্ত
 ০২. পদ্ম পুরাণ
মহাপুরাণ, শ্লোকসংখ্যা ৫৫০০০ (পঞ্চান্ন হাজার)
  1. ভুমি খণ্ড (পদ্মপুরাণ) ()
  2. স্বর্গ খণ্ড (পদ্মপুরাণ) ()

০০১. সূতের প্রতি ঋষিগণের প্রহ্লাদচরিত্র জানিবার অভিপ্রায়ে প্রশ্ন, সূত কর্ত্তৃক ঋষিগণের নিকট ব্রহ্ম-ব্যাস-সংবাদ বর্ণন

 সূতের প্রতি ঋষিগণের প্রহ্লাদচরিত্র জানিবার অভিপ্রায়ে প্রশ্ন, সূত কর্ত্তৃক ঋষিগণের নিকট ব্রহ্ম-ব্যাস-সংবাদ বর্ণন

 ভুমি খণ্ড (পদ্মপুরাণ
পদ্ম পুরাণ
ভুমি খণ্ড
প্রথম অধ্যায়
সূতের প্রতি ঋষিগণের প্রহ্লাদচরিত্র জানিবার অভিপ্রায়ে প্রশ্ন, সূত কর্ত্তৃক ঋষিগণের নিকট ব্রহ্ম-ব্যাস-সংবাদ বর্ণন
নারায়ণ, নর, নরোত্তম, দেবী এবং সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া, পরে জয় গ্রন্থ উচ্চারণ করিবে।
ঋষিগণ কহিলেন,–হে সর্ব্ব-তত্ত্বার্থকোবিদ মহভাগ সূত! শ্রবণ কর, আমাদের বুদ্ধি-বিলোপী এক বিষম সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে। হে বিদ্বন্‌! কোন কোন দ্বিজশ্রেষ্ঠ পুরাণে প্রহ্লাদপ্রসঙ্গে এইরূপ বলিয়া থাকেন যে, প্রহ্লাদ পঞ্চবর্ষ বয়সেই কেশবকে পরিতুষ্ট করিয়াছিলেন। কিন্তু দেবাসুর-সমর উপস্থিত হইলে, তিনি কেন হরির সহিত যুদ্ধ করেন এবং বাসুদেব কর্ত্তৃক নিহত হইয়া বৈষ্ণব দেহে প্রবিষ্ট হন? সূত কহিলেন,–দ্বিজগণ! পূর্ব্বে কশ্যপ বিষয় বিদিত ছিলেন। ব্রহ্মা স্বয়ং ইহা মহাত্মা ব্যাসের নিকট বর্ণন করেন। ধীমান ব্যাস পরে উহা প্রকাশ করিয়াছেন। আমি সেই ব্যাসবর্ণিত বিষয়ই আপনাদের নিকট বলিতেছি। বিধিদেব নিজেই এই সন্দেহ-নিদান ছেদন করিয়া দেন। -
ব্যাসদেব বলিয়াছিলেন,–হে মহাভাগ সূত! ব্রহ্মা প্রহ্লাদজন্ম যেরূপ বলিয়াছেন এবং পুরাণেও যাহা অন্য প্রকার শুনিয়াছি, তাহা শ্রবণ কর। দেব-পুজিত প্রহ্লাদ জন্মিবামাত্র সর্ব্বসুখাবহ বৈষ্ণবপথ অবলম্বন করিয়া মহাভাববতশ্রেষ্ঠ হইয়াছিলেন। তিনি বিষ্ণুর সহিত যুদ্ধার্থ সপুত্র সমরে অবতীর্ণ হন। পরে বাসুদেব কর্ত্তৃক নিহত হইয়া বৈষ্ণবী তনু লাভ করেন। এই মহাত্মা প্রহ্লাদের উৎপত্তি-বিবরণ শ্রবণ কর। ইনি বীর্য্যশালী ছিলেন স্বীয় পুত্রাদির সহিত সমরে অবতীর্ণ হইয়া বিষ্ণুর সহিত যুদ্ধ করেন এবং স্বীয় প্রভাবে বৈষ্ণব তেজে প্রবিষ্ট হন। সেই বীর্য্যবান প্রহ্লাদ পুরাকল্পে যেরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, সংক্ষেপে সে বৃত্তান্ত তোমার নিকট বলিতেছি। পশ্চিম সাগরের প্রান্তে সকল ঋদ্ধি-সিদ্ধি-সমর্থিতা দ্বারকাপুরী বিরাজমান। তথায় বেদার্থকোবিদ যোগজ্ঞ যোগী বিখ্যা শিবশর্ম্মা বাস করেন। তাঁহার পাঁচ পুত্র; পাঁচ জনই শাস্ত্রজ্ঞ। পুত্রগণের নাম যজ্ঞশর্ম্মা, বেদশর্ম্মা, ধর্ম্মশর্ম্মা, বিষ্ণুশর্ম্মা এবং সোমশর্ম্মা। পঞ্চপুত্রই পিতৃভক্ত; পিতৃভক্তি ভিন্ন অন্য ধর্ম্ম তাঁহারা জানিতেন না। সেই মহাত্মগণ সর্ব্বদা তদ্ভাবে ভাবিত হইয়াই থাকিতেন। - ১৫
দ্বিজবর শিবশর্ম্মা পুত্রগণের পিতৃভক্তি দর্শনে চিন্তা করিলেন, আমি সুরবরদিগকে আকর্ষণ করিব; প্রকৃত পিতৃভক্তের ভাব আমার এই পুত্রগণের অন্তরে হয় তো নাই; যদি থাকে, তবে তাহা যেরূপে জানিতে পারি, সে চেষ্টা আমি বুদ্ধিবলে করিব। হে দ্বিজবরগণ! শিবশর্ম্মা বিষ্ণুর প্রসাদে সর্ব্বসিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। তিনি বিষয় জানিবার জন্য সদুপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। বিশিষ্ট ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠ উপায়জ্ঞ শিবশর্ম্মা চিন্তা করিতে করিতে মায়াবিস্তারে এক উপায় উদ্ভাবন করিলেন। তিনি পুত্রগণের সমক্ষে ছল প্রদর্শন করিয়া দেখাইলেন,–তাহাদের মাতা প্রবল জ্বর রোগে মৃত্যুগ্রস্ত হইয়াছেন। পুত্রগণ দেখিলেন,–মাতা মরিয়াছেন। তদ্দর্শনে তাঁহারা পিতার নিকটা গিয়া বলিলেন,–হে মহাভাগ! আমরা যাঁহার গর্ভোদরে প্রবর্দ্ধিত হইয়াছিলান, তিনি নিজ কলেবর পরিহার করিয়া স্বর্গে গিয়াছেন, আপনি এক্ষণে কি আদেশ করেন? শিবশর্ম্মা ভক্তিপরায়ণ জ্যেষ্ঠ পুত্র যজ্ঞশর্ম্মাকে আহ্বাব করিয়া আদেশ করিলেন,–পুত্র! তুমি সর্বাঙ্গ ছেদন করিয়া যত্র তত্র নিক্ষেপ কর। পুত্র পিতার সেরূপ আদেশ পাইলেন, তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদণ করিলেন এবং পুনরায় পিতার নিকটা আসিয়া বলিলেন,–পিতঃ। আপনি যে যে আদেশ করিয়াছিলেন, তৎসমস্তই আমি সম্পাদন করিয়াছি। এক্ষণে অন্য কার্য্যের জন্য আদেশ করুন, দুর্জ্জয় বা দুর্লভ হইলেও সে সকল আদেশ পালন করিব। দ্বিজবর শিবশর্ম্মা ইহাতে জ্যেষ্ঠপুত্র মহাভাগ যজ্ঞশর্ম্মাকে নিশ্চিত রূপে প্রশস্ত পিতৃভক্ত জানিয়া, স্বীয় পুত্র বেদশর্ম্মার পিতৃভক্তি পরীক্ষার জন্য তাঁহাকে আহ্বান করিয়া আদেশ করিলেন,–পুত্র। কামার্ত্ত আমি, স্ত্রী বনা তিষ্ঠিতে পারিতেছি না! এই বলিয়া তিনি মায়াবলে এক সর্ব্ব-সৌভাগ্যশালিনী নারী মূর্ত্তি প্রদর্শন করত বলিলেন,–বৎস! কৃতনিশ্চয় হইয়া তুমি আমারই জন্য এই নারীকে আনয়ন কর। ১৬-৩০
পুত্র আদিষ্ট হইয়া পিতাকে কহিলেন,–আপনার প্রিয়ানুষ্ঠান করিব। এই বলিয়া পিতৃপদে নমস্কারপূর্ব্বক বেদশর্ম্মা সেই নির্দ্দিষ্ট নারীর নিকট গিয়া কহিলেন,–দেবি! কামশরপীড়িত মদীয় পিতা আপনাকে প্রার্থনা করিতেছেন। অতএব আপনি আমার জরাযুক্ত পিতার প্রতি প্রসাদসুমুখী হউন। হে চারুগাত্রি সুন্দরি! আমার পিতাকে ভজনা করুন। শিবশর্ম্মার মায়া-নারী বেদশর্ম্মার উক্তি শ্রবণ করিলেন, কহিলেন,–পিতা তোমার জরাজীর্ণ, শ্লেষ্মযুক্ত, মুখরোগী, ব্যাধিগ্রস্ত, শিথিলেন্দ্রিয়, আর্ত্ত বৃদ্ধ। আমি তাহার সঙ্গ কখনই ইচ্ছা করি না, আমি রমনেচ্ছা করি তোমার সহিত; তোমারই আমি প্রিয়াচরণ করিব। তুমি রূপ-সৌভাগ্য-গুণ-রত্নালঙ্কৃত, দিব্য-লক্ষণ-লক্ষিত, মহাতেজা সুপুরুষ; সুতরাং মানদ! শ্রবণ কর, বৃদ্ধ পিতার প্রয়োজন কি? আমার অঙ্গভোগ-বৈভবেই তুমি সর্ব্ব সুদুর্লভ সামগ্রী প্রাপ্ত হইবে। হে বিপ্র! তুমি যাহা যাহা প্রার্থণা কর, আমি নিশ্চয়ই তাহা প্রদান করিব। বেদশর্ম্মা পাপযুক্ত অপ্রিয় বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন,–দেবি! তোমার বাক্য অধর্ম্মযুক্ত, পাপসম্মিশ্র এবং অন্যায়, আমি পিতৃভক্ত নিরপরাধ ব্যক্তি, আমাকে এরূপ বাক্য তুমি বলিও না। হে শুভে! আমি পিতার জন্যই আসিয়াছি, এবং তাঁহারই জন্য তোমায় প্রার্থনা করিতেছি। তুমি অন্যথা বলিও না, আমার পিতাকেই আসিয়া ভজনা কর। হে সুন্দরি! ত্রৈলোক্যে তোমার যাহা যাহা প্রার্থনীয় আছে, তাহা দুর্লভ দেবরাজ্য অপেক্ষা অধিক হইলেও, আমি প্রদান করিব, একথা নিঃসন্দেহ। মায়া-নারী কহিলেন,–পিতার নিমিত্ত তুমি যখন আমায় এতদূর পর্য্যন্ত দিতে সমর্থ, তখন আমি ইচ্ছা করি, তুমি অদ্যই আমায় ইন্দ্র মহাদেবকে দর্শন করাও; এই দুর্লভ সামগ্রী নিশ্চয়ই সম্প্রতি তুমি প্রদান করিতে সমর্থ। হে মহাভাগ! তোমার কিরূপ আত্মপ্রভাব তাহা দেখাও। দেবশর্ম্মা কহিলেন,–দেবি! দেখ দেখ, আমার তপঃপ্রভাব! আমার আহ্বানে ইন্দ্রাদি সুরবরগণ সমাগত হইয়াছেন। তাঁহারা আসিয়া বেদশর্ম্মাকে বলিলেন,–হে দ্বিজোত্তম! আমরা কি করিব? তুমি যাহা ইচ্ছা করিবে, তাহাই নিশ্চয় প্রদান করিব। ৩১-৪৫
বেদশর্ম্মা বলিলেন,–দেবগণ! যদি মৎপ্রতি প্রসন্ন হইয়া প্রসাদসুমুখ হইয়া থাকেন, তবে প্রার্থনাতাঁহারা আমায় অমল পিতৃপদভক্তি প্রদান করুন। সুরগণ বলিলেন,–তথাস্তু। এই বলিয়া তাঁহারা যথাস্থানে প্রস্থান করিলেন। তদ্দর্শনে মায়া-নারী কহিল,–বিপ্র! তোমার তপোবল দেখিলাম, দেবগণে আমার প্রয়োজন নাই, আমায় যদি কিছু প্রদান করিতে ইচ্ছা করিয়া থাক, আমাকে যদি পিতার জন্য লইতে চাও, তবে আমার প্রিয়ানুষ্ঠান কর। হে বিপ্র! তুমি নিজ হস্তে স্বীয় মস্তক ছেদন করিয়া আমায় অপর্ণ কর। বেদশর্ম্মা করিলেন,–অদ্য আমি ধন্য হইলাম, ঋণত্রয় হইতে মুক্ত হইলাম। শুভে! আমি নিজ মস্তক প্রদান করিতেছি, ধর, গ্রহণ কর। এই বলিয়া তীক্ষ্ণধার শিত শস্ত্র দ্বারা স্বীয় শিরঃ কর্ত্তন করিয়া বেদশর্ম্মা সহাস্যবদনে তাঁহাকে অপর্ণ করিলেন। তখন মায়ানারী সেই শোনিতপ্লুত মস্তক লইয়া শিবশর্ম্মা মুনির নিকট গমনপূর্ব্বক বলিল,–বিপ্র! আপনার পুত্র বেদশর্ম্মা আপনার নিমিত্ত নিজেই নিজ মস্তক ছেদন করিয়া প্রেরণ করিয়াছেন, ইহা গ্রহণ করুন। আপনার সেই পিতৃভক্ত পুত্র আপনারই জন্য আমায় এই উত্তমাঙ্গ প্রদান করিয়াছিলেন, অতএব হে দ্বিজবর! আপনি আমায় উপভোগ করুন। বেদশর্ম্মার পুণ্যশীল ভ্রাতৃগণ বেদশর্ম্মার সেই সাহস দর্শনে কম্পিতগাত্র হইলেন এবং তাঁহারা পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিলেন,–আমাদের ধর্ম্মসাধ্বী মাতা সত্যসমাধিতলে প্রাণ পরিত্যাগ করিয়াছেন। এই মহাভাগ ভ্রাতা আমাদের পিতার জন্যই মরিলেন, অতএব পিতার নিমিত্ত এই শুভানুষ্ঠাতা ভ্রাতা আমাদের অশেষ ধন্যবাদার্হ। দ্বিজ শিবশর্ম্মা পুত্রগণের সেই বাক্য শুনিয়া বুঝিলেন,–বেদশর্ম্মা প্রকৃতই পিতৃভক্ত, এবং সেই ভক্তিবশেই সে আপন মস্তক কর্ত্তন করিয়াছে। ইহা বুঝিয়া তিনি তৃতীয় পুত্র ধর্ম্মশর্ম্মাকে বলিলেন,–তুমি এই মস্তক গ্রহণ কর। ৪৬-৫৮
প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত

০১. সূত-শৌনক-সংবাদ, সৃষ্টির পূর্ব্বাবস্থা ব্রহ্মাণ্ডোৎপত্তিপ্রক্রিয়া বর্ণন

০১. সূত-শৌনক-সংবাদ, সৃষ্টির পূর্ব্বাবস্থা ব্রহ্মাণ্ডোৎপত্তিপ্রক্রিয়া বর্ণন
  স্বর্গ খণ্ড (পদ্মপুরাণ)
পদ্মপুরাণ
স্বর্গ খণ্ড (পদ্মপুরাণ)
প্রথম অধ্যায়
সূত-শৌনক-সংবাদ, সৃষ্টির পূর্ব্বাবস্থা ব্রহ্মাণ্ডোৎপত্তিপ্রক্রিয়া বর্ণন
একদা হিমাচলবাসী জ্বলদগ্নিকল্প বেদপারগ ত্রিকালজ্ঞ মহাত্মা মুনিগণ এবং মহেন্দ্রাচল, বিন্ধ্যশৈল, অর্ব্বুদারণ্য, পুষ্করারণ্য, জম্বুমার্গ, কুরুক্ষেত্র প্রভৃতি নানাপুণ্যাশ্রমবাসী অমলাত্মা মুনিগণ শৌনক ঋষির দর্শনাভিলাষে সোৎসুকচিত্তে শিষ্যগণ সহ নৈমিষারণ্যে সমাগত হইলে। তাঁহারা শৌনক ঋষির যথাযোগ্য পূজা করিলে শৌনকও তাঁহাদিগকে যথাযোগ্য পূজা করিয়া বৃষী প্রভৃতি নানাবিধ বিচিত্র আসন প্রদান করিলেন। তপোধন মুনিগণ সেই সকল আসনে আসীন হইয়া পরস্পর কৃষ্ণ বিষয়ক পবিত্র কথোপকথন করিতে লাগিলেন। সেই ভ্যবিতাত্মা মুনিগণের কথাবসারে মহাদ্যুতি মহাতেজা সূত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ব্যাসশিষ্য পুরাণজ্ঞ রোমহর্ষণ নামক সেই সূত সেই মুনিগণকে যথাযোগ্য প্রণাম করিলেন এবং সেই মুনিগণ কর্ত্তৃক যোগ্যরূপে সৎকৃত হইলেন। তিনি উপবিষ্ট হইলে শৌনকাদি মহাভাগ তপোধন মহর্ষিগণ সেই ব্যাসশিষ্য রোমহ সূতকে প্রশ্ন করিলেন। -১০
ঋষিগণ বলিলেন,–হে সুব্রত মহাবুদ্ধে পৌরাণিক রোমহর্ষণ! আমরা পূর্ব্বে তোমার নিকট মহাপুণ্যা পৌরিণিকী কথা শুনিয়াছি। সম্প্রতি আমাদের অবকাশ আছে, নিমিত্ত হরিকথা শুনিবার জন্য উৎসুক হইয়াছি। মানবগণের তাহাই পরম ধর্ম্ম, যাহা দ্বারা অধোক্ষজ হরির প্রতি ভক্তি জন্মে। অতএব তুমি পুনরায় হরিবার্ত্তাসমাম্বিত পুরাণ কীর্ত্তন কর। হে সূত! হরিকথা ব্যতীত অন্যকথা শ্মশান সদৃশ। হরিই স্বয়ং তীর্থরূপে অবস্থান করেন। ইহা আমরা শুনিয়াছি। তুমি পুণ্যপ্রদ তীর্থ সকলের নাম কীর্ত্তন কর। এই চরাচর জগৎ কোথা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে? কাহা দ্বারা পরিপালিত হয়? কোথায়ই বা লয় প্রাপ্ত হয়? কোন্কোন্ক্ষেত্র পুণ্যজনক? কোন্কোন্পর্ব্বত পূজ্য? কোন্কোন্নদী মানবগণের শুভ পুণ্যপ্রদ এবং পাপনাশক? হে মহাভাগ! এই সকল বৃত্তান্ত যথাক্রমে কীর্ত্তন কর। ১১-১৭
সূত বলিলেন,–হে দ্বিজোত্তমগণ! আমি অদ্য স্বর্গ (স্বর্গখণ্ড) বলিব; যাহা দ্বারা সনাতন পরমাত্মা ভগবানকে জানিতে পারা যায়। হে দ্বিজোত্তমগণ! সৃষ্টি-প্রলয়ের পূর্ব্বে কিছুই ছিল না। পরে ব্রহ্ম নামক সর্ব্বাকারক এক জ্যোতি হইল। উহা নিত্য, নিরঞ্জন, শান্ত, নির্গুণ, নিত্যনির্ম্মল, আনন্দনিকেতন, স্বচ্ছ, সর্ব্বজ্ঞ, জ্ঞানস্বরূপ, অনন্ত, অজ, অব্যয়, অবিনাশী, সদাস্বচ্ছ, অচ্যুত, ব্যাপক মহৎ। মুমূক্ষুগণ উহাই আকাঙ্খা করিয়া থাকেন। সৃষ্টিকাল উপস্থিত হইলে সেই ব্রহ্ম নিজকে নিজে জ্ঞানস্বরূপ এবং বিকারগর্ভ জানিয়া সৃষ্টি করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। সেই ব্রহ্ম হইতে প্রধান (প্রকৃতি) উদ্ভূতা হইলেন। তিনি মহত্তত্ত্ব সাত্বিক, রাজস, তামস এই তিন প্রকার। উহা প্রধান তত্ত্বের দ্বারা ত্বক্দ্বারা বীজের ন্যায় আবৃত। মহত্তত্ত্ব হইতে বৈকারিক, তৈজস, ভূতাদিতামস, এইতিন প্রকার অহঙ্কার উৎপন্ন হয়। মহত্তত্ত্ব যেমন প্রধান দ্বারা আবৃত, তদ্রুপ অহঙ্কারতত্ত্বো মহত্তত্ত্ব দ্বারা আবৃত। উক্তি ভূতাদি অহঙ্কার বিকৃত হইয়া শব্দতন্মাত্র উৎপাদন করিল; উহা হইতে শব্দগুণ আকাশ উৎপন্ন হইল। উক্ত শব্দতন্মাত্র হইতে স্পর্শতন্মাত্র জন্মিল, উহা হইতে স্পর্শগুণ বলবান্বায়ু উদ্ভূত হইল। উক্ত শব্দ তন্মাত্র আকাশ স্পর্শতন্মাত্রকে আবরণ করিল। অনন্তর বায়ু বিকৃত হইয়া রূপতন্মাত্র উৎপাদন করিল। উহা হইতে রূপগুণ জ্যোতিঃ উৎপন্ন হইল। স্পর্শ তন্মাত্র বায়ু উক্ত রূপতন্মাত্রকে আবরণ করিল। উক্তি জ্যোতিঃ বিকৃত হইয়া রসতন্মাত্র সৃষ্টি করিল। উহা হইতে রসগুণ জল উৎপন্ন হইল। উক্তি জল বিকৃত হইয়া গন্ধতন্মাত্র সৃষ্টি করিল। উহা হইতে সর্ব্বভূতাপেক্ষা অধিকগুণবিশিষ্টা এই পৃথিবী জন্মিল। সঙ্গতবশতঃ উৎপন্ন হইয়াছে বলিয়া উহার গুন গন্ধ। সেই ভূতে (সূক্ষ্মরূপে) কিঞ্চিত কিঞ্চিত আছে, নিমিত্র তন্মাত্র নাম হইল। তন্মাত্র সকল অবিশেষ; উহা হইতে উৎপন্ন বিশেষ সকল পরে বলিতেছি। হে তপোধন মুনিবর্য্যগণ! তামস অহঙ্কার হইতে উৎপন্ন এই ভূততন্মাত্র-সর্গ সংক্ষেপে কীর্ত্তিত হইল। ১৮-৩৬
তৈজস অহঙ্কার হইতে দশ ইন্দ্রিয় এবং বৈকারিক অহঙ্কার হইতে (ইন্দ্রিয়াদিত্ব) ইন্দ্রাদি দশ দেবতা (উভয়াত্মক) মন উৎপন্ন হইল। ইহা তত্ত্বজ্ঞগণ কীর্ত্তন করিয়াছেন। হে কূলপাবনগণ! (এক্ষণে) পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয় এবং তাহাদের কর্ম বলিতেছি। শ্রোত্র, ত্বক্‌, চক্ষু, জিহ্বা, নাসিক, এই পাঁচটি দ্বারা শব্দাদি (পঞ্চ বিষয়ের) জ্ঞান সিদ্ধ হয়। পায়ু, উপস্থ, হস্ত, পদ, বাক্য, এই পাঁচটী দ্বারা বিসর্গ (মলত্যাগ), আনন্দ, সিদ্ধি (আদন), গতি, উক্তিএই পাঁচ কর্ম্ম সিদ্ধ হয়। আকাশ, বায়ু, তেজ, জল, পৃথিবী, ইহারা উত্তরোত্তর শব্দাদি গুণে সংযুক্ত। বিভিন্নগুণযুক্ত পৃথক্ভাবে অবস্থিত উক্ত ভূত সকল পরস্পর মিলিত না হইয়া কিছুই সৃষ্টি করিতে সক্ষম হয়িল না। পরে পরস্পর আশ্র-আশ্রিত ভাবে ক্রমে মিলিত হইয়া একীভূত হইল; কিন্তু তাহাদের পরস্পরের কিঞ্চিত কিঞ্চিত বৈলক্ষণ্যও রহিল। পুরুষের অধিষ্ঠান বশতঃ প্রধানের অনুগ্রহে উক্ত মহদাদি (অবিশেষ সূক্ষ্ম ভূত) বিশেষ (স্থূল ভূত) দ্বারা একটী অণ্ড উৎপাদন করিল। হে মহাপ্রাজ্ঞগণ! উক্ত অণ্ড ক্রমে সকল ভূত হইতে বৃদ্ধি লাভ করত জলবুদ্বুদ্বৎ জলে ভাসিতে লাগিল। উক্ত অণ্ডই প্রাকৃত ব্রহ্মরূপধারী বিষ্ণুর অনুত্তম স্থান। অব্যক্ত স্বরূপ বিশ্বেশ্বর প্রভু সেই বিষ্ণু স্বয়ংই ব্রহ্মা রূপে উহাতে অবস্থিত হইলেন। উক্ত মহাত্মা হইতে স্বেদজ, অণ্ডজ, জরায়ুজ, মহীধর, গর্ভোদক, সমুদ্র, এই সকল উৎপন্ন হইল। উক্ত অণ্ডমধ্যে অদ্রি, দ্বীপ, সমুদ্র, জ্যোতিঃ দেবতা, অসুর, মানুষাদি সহিত সমস্ত লোক উদ্ভূত হইল। শ্রীকেশবের ইচ্ছায় অনাদি-নিধন বিষ্ণুর নাভি হইতে যে একটি পদ্ম জন্মিল, উহাই একটী স্বর্ণ-অণ্ডস্বরূপ। উহাতে পরম দেব হরি স্বয়ংই ব্রহ্মা রূপে অবস্থান করত জগৎসৃষ্টি করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি এই জগৎ (কল্পিত) যুগে যুগে সৃষ্টি করেন এবং কল্পে কল্পে নরসিংহাদি রূপে বা রুদ্ররূপে সংহার করিয়া থাকেন। তিনি ব্রহ্মা রূপে এই সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করত পালনেচ্ছায় রামাদিরূপে ধারণপূর্ব্বক পালন করেন এবং সংহার কামনায় রুদ্ররূপ হইয়া থাকেন। ৩৭-৫৩
প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত



০১. সংক্ষেপে বিষ্ণুপুরাণের প্রশ্ন । রাক্ষস সত্রের বিবরণ

প্রথম অংশ । প্রথম অধ্যায়
মঙ্গলাচরণ
সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়কর্ত্তা জগতের ঈশ্বর বিষ্ণুকে শ্রদ্ধা ভক্তি পূর্ব্বক প্রণাম করিয়া ব্রহ্মা, দক্ষ, আদি সৃষ্টির প্রধান জীবগণ ও গুরু কপিলকে নমস্কার করিয়া বেদ তুল্য পুরাণ বলিতেছি।
সংক্ষেপে বিষ্ণুপুরাণের প্রশ্ন
নানাশাস্ত্রে সুপণ্ডিত বশিষ্ঠের পুত্র মহামুনি পরাশর পূজাদি সম্পন্ন করিয়া বসিয়া আছেন এমত সময়ে মৈত্রেয় প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, গুরো! আপনার নিকট বেদ বেদাঙ্গ ও ধর্ম শাস্ত্র পড়িয়াছি, এক্ষণে যে রূপে জগতের সৃষ্টি ও লয় হয় তাহা আমি আপনার নিকট শুনিতে ইচ্ছা করি। হে ব্রহ্মণ্‌! এই চরাচর জগৎ কেমনে কোথা হইতে উৎপন্ন হইল? আগে কোথায় লীন ছিল? কোথায় বা পুনরায় লয় প্রাপ্ত হইল? ভূতের পরিমাণ কত? কেমনে দেবাদির উৎপত্তি হইয়াছে? সমুদ্র, পর্ব্বত ও পৃথিবীর আধার কিরূপ? সূর্যাদির পরিমান কত? দেবাদির বংশে কে কি রূপে জন্মিয়াছে? মনু ও মন্বন্তর কত ও কিরূপ? ব্রহ্মার পরমায়ু ও যুগ ধর্ম্মের বিবরণ কি? দেবর্ষি ও রাজগণের চরিত কি রূপ? কিরূপে বেসব্যাস বেদবিভাগ করিয়াছেন? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ও আশ্রমবাসীদের ধর্ম কি? হে বশিষ্ঠ নন্দন! আপনার নিকট এই সমুদায় শ্রবণ করিতে বাসনা করি।
পরাশর কহিলেন, মৈত্রেয়! পূর্ব্বে আমার পিতা যাহা বলিয়াছেন সেই বহুকালের কথা তুমি অদ্য আমাকে স্মরণ করিয়া ছিলে।
রাক্ষস সত্রের বিবরণ
হে মৈত্রেয়! যখন আমি শুনিলাম বিশ্বামিত্র কর্ত্তৃক প্রেরিক রাক্ষস আমার পিতাকে ভক্ষণ করিয়াছে তখন আমি ক্রোধে অন্ধ হইয়া রাক্ষসগণের বিনাশ জন্য যাগ আরম্ভ করিলাম। রাক্ষসগণ সেই যজ্ঞে ভস্ম হইতে আরম্ভ হইলে আমার পিতামহ মহাত্মা বশিষ্ঠ আমাকে বলিলেন, বৎস্য! ক্রোধ ত্যাগ কর, রাক্ষসেরা তোমার পিতার প্রতি নির্দ্দয় ব্যবহার কইয়াছে বটে কিন্তু তাহারা অপরাধী নহে। পূর্ব্বজন্মের ফল ভোগ ব্যতীত কে কাহারে বধ করিতে পারে? মানবেরা অনেক ক্লেশে যশঃ ও তপস্যা সঞ্চয় করে, ক্রোধে অল্প সময়ের মধ্যেই তাহা নষ্ট করিয়া ফেলে, ক্রোধই স্বর্গ ও মোক্ষের বাধা স্বরূপ, সেই জন্য মহর্ষিরা সতত ক্রোধ ত্যাগ করিয়া থাকেন, নিরপরাধী নিশাচরগণকে দগ্ধ করিবার আবশ্যক নাই। তুমি সেই যজ্ঞ হইতে বিরত হও; ক্ষমাই সাধুদিগের প্রধান গুণ। পিতামহের বাক্যে যজ্ঞে খান্র দিলে পিতামত সন্তুষ্ট হইলে। সেই সময়ে সেই খানে পুলস্ত্য উপস্থিত হইয়াছিলেন বলিয়া পিতা তাঁহাকে অর্ঘ প্রদান করিলে তিনি আমারে সমস্ত শাস্ত্রজ্ঞ হইবে বলেন এবং আমার পিতামহ তাহাই ঘটিবে বলিয়াছিলেন।
বৎস্য মৈত্রেয়! পূর্ব্বে মহাত্মা বশিষ্ঠ, পুলস্ত্য যাহা বলিয়াছিলেন, এক্ষণে তোমার প্রশ্নে তৎসমুদায় আমার স্মরণ হইল, সমুদায় পুরাণ সংহিতা তোমাকে উত্তম রূপে বলিতেছি শ্রবণ কর।
বিষ্ণু এই জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন। প্রলয়কালে তাঁহাতেই লয় প্রাপ্ত ছিল, তিনি পালন ও সঙ্ঘার কর্ত্তা এবং তিনিই জগতের উৎপত্তির কারণ।
ইতি শ্রীভুবনচন্দ্র বসাকের বিষ্ণুপুরাণ অনুবাদে প্রথম অংশের প্রথম অধ্যায়।।১।।

শিব পুরাণ (বৃহৎ)

মহাপুরাণ, শ্লোকসংখ্যা ২৪০০০ (চব্বিশ হাজার)।

০১. ঋষিগণের প্রশ্ন

প্রথম অধ্যায়
নারায়ণ, নর, নরোত্তম, সরস্বতী এবং বেদব্যাসকে প্রণাম করিয়া জয় অর্থাৎ পুরাণাদি পাঠ করিবে।
জগতের পিতামহ হরপার্বতীকে এবং তদীয় পুত্র গণপতিকে প্রণাম করিয়া আমি ইহা বর্ণনা করিতেছি। যাঁহার বদনে সরস্বতী, বক্ষঃস্থলে লক্ষ্মী এবং হৃদয়ে পরম জ্ঞান সতত বর্তমান–আমি সেই নৃসিংহদেবকে ভজনা করি।
একদা নৈমিষ্যারণ্যবাসী মুনিগণ, নিখিলগুণাকর ব্যাস-শিষ্য সূতকে পরমভক্তিসহকারে জিজ্ঞাসা করিলেন,–সূত! মহাভাগ সূত! চিরজীবী হও, সুখে কালযাপন কর। হে অনঘ! আমরা তোমার মুখ-কমল-বিচ্যুত জ্ঞানামৃত নিরন্তর পান করিয়াও তৃপ্তিলাভ করিতে পারিতেছি না, ইচ্ছা হইতেছে আরও পান করি, অতএব পুনরায় কিঞ্চিৎ জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছুক হইয়াছি;–তুমি ব্যাসদেবের প্রসাদে সর্বজ্ঞতা লাভ করিয়া কৃতার্থ হইয়াছ। ১-৫।
ভূত, ভবিষ্যত, বর্তমান–কিছুই তোমার অবিদিত নাই। গুরুকৃপাবলে তুমি সকল বিষয়ই সফল করিয়াছ। এখন তুমি সর্বোত্তম শিবরূপ, পরম দিব্য তদীয় পূজা এবং তাঁহার নানাবিধ আচরণের কথা অনুগ্রহপূর্বক কীর্ত্তন কর। নির্গুণ মহেশ্বর, জগতে আবার সগুণ হইলেন কিরূপে? আমরা কেহই সবিশেষ শিবতত্ত্ব অবগত নহি। ত্রৈলোক্যমঙ্গল বিধাদা দেবদেব শঙ্কর জগৎ সৃষ্টির পূর্বে জগতের অস্তিতা কালে এবং প্রলয় হইলে কিরূপে থাকেন? তিনি প্রসন্ন হন কিরূপে? প্রসন্ন হইয়াই বা লোককে কিরূপ ফল প্রদান করেন?–হে সুব্রত! তৎসমস্ত কীর্ত্তন কর। শুনা আছে, ভগবান সদ্য প্রসন্ন হন, তাহা সত্য কি না? এবং এতদ্ভিন্ন শিবসম্বন্ধে যাহা যাহা বক্তব্য, হে অনঘ! তৎসমুদায় তোমার বলিতে হইবে। সূত, নৈমিষারণ্যে ঋষিমণ্ডলীকর্ত্তৃক এইরূপ জিজ্ঞাসিত হইয়া তাঁহাদিগকে সমক্ষে প্রশ্নানুসারে সমুদয় কথা বলিয়াছিলেন। ৬-১২।
প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত।।১।।

০৫. শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ (শ্যামপদ ন্যায়ভূষণ)

মহাপুরাণ, শ্লোকসংখ্যা ১৮০০০ (আঠার হাজার)। মহাভাগবত পুরা - মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ বেদব্যাস প্রণীত, হুগলী জেলার অন্তঃপাতি আঁটপুর নিবাসী দর্শনশাস্ত্রাধ্যাপক শ্রীযুক্ত শ্যামাপদ ন্যায়ভূষণ কর্ত্তৃক বঙ্গভাষায় অনুবাদিত, আনরবাটীনিবাসী শ্রী রামতারক রায় কর্তৃক ১২৮০ সনে প্রকাশিত
  1. মহাভাগবত পুরাণ – ০১ম খণ্ড (১) 

০১. সূত ঋষির নৈমিষারণ্যে গমন । বেদব্যাসের প্রতি দৈববাণী । চতুর্ব্বেদের ব্রহ্মতত্ত্বকথন । শ্রুতিগণ কর্ত্তৃক ব্রহ্মময়ী দুর্গার স্তব । ব্রহ্মময়ীর নানাপ্রকার রূপধারণ । বেদব্যাসের পুরাণ দর্শন

সূত ঋষির নৈমিষারণ্যে গমন । 
মহাভাগবত পুরাণ
প্রথম খণ্ড । প্রথম অধ্যায়
নারায়ন এবং নরোত্তম নর (১) ও সরস্বতী দেবীকে নমস্কার করিয়া জয় কীর্ত্তন করিবে।
যাঁহার আরাধারনা করিয়া বিধাতা এই স্থুল সূক্ষ্ম জগতের সৃষ্টি, হরি পালন এবং শিবরূপী দেব সংহার করেন; যিনি যোগিগণের ধ্যেয় বস্তু; মুনিগণ যাঁহাকে মূল প্রকৃতি (২) বলেন, এবং যাঁহার স্তব করিতে করিতে তত্ত্বজ্ঞানী হইয়া নিজ নিজ কৃতার্থতাও সম্পাদন করেন; সেই বিশ্বজননীর চরণে শত শত প্রণাম।
যিনি স্বর্গ এবং মোক্ষরূপ অতুল্যফলদাত্রী, যিনি নিজ ইচ্ছায় এই জতৎ সংসার সৃষ্টি করিয়া তন্মধ্যে স্বয়ং জন্মলাভ করত শম্ভুকে পতিত্বরূপে বরণ করিয়াছেন, কঠোর তপস্যা দ্বারা শম্ভু যাঁহাকে পত্নী লাভ করিয়া চরণদ্বয় হৃদয়ে ধারণ করিয়াছেন, হে শ্রোতৃবর্গ! সেই দেবী তোমাদিগকে রক্ষা করুন।
————-
১। “নারায়ণ’ অর্থাৎ, অবিধ্যার সংশ্রবশূণ্য, ব্রহ্ম; “নরোত্তম,” অর্থাৎ, জড়াদি হইতে উৎকৃষ্টতর “নর” অর্থাৎ জীবাত্মা; “সরস্বতী,” ঐ উভয়ের জ্ঞাপিকা বানী “জয়,” অর্থাৎ, যদ্দ্বারা সংসার জয় করা যায়, সেই গ্রন্থ। ভারতকীকায় নীলকন্ঠ।
২। অর্থাৎ, সকলের আদি কারণ।
————-
সূত ঋষির নৈমিষারণ্যে গমন
পরম-ধার্ম্মিক, বেদার্থবেত্তার অগ্রগণ্য সূত গোস্বামী যদৃচ্ছাক্রমে একদা নৈমিষাতণ্য ক্ষেত্রে উপস্থিত হইলে শৌনকাদি ঋষি জিজ্ঞাসা করিলেন, হে মহাত্মন্‌ সূত! আপনি বেদব্যাসের প্রিয় শিষ্য, এবং সর্ব্ব বেদের যথার্থ তত্বজ্ঞ; অতএব সম্প্রতি এরূপ কোন পুরাণ কীর্ত্তন করুন, যাহাতে স্বর্গ ও মোক্ষ, উভয়ই লাভ হয়; এবং যাহাতে বিশ্বজননী দুর্গা দেবীর মাহাত্ম্য, উত্তমরূপে প্রকাশমান আছে, যাহা শ্রবণ করিলে জ্ঞানহীন ব্যক্তিরও দুর্গা দেবীতে দৃঢ়তর ভক্তি উত্তেজিতা হয়।
সূত কহিলেন, হে মহর্ষিগণ! আপনারা পবিত্রময় ব্রহ্মবংশে জন্মলাভ করিয়া অনুরূপ কার্যানুষ্ঠানে তপস্যার পরা কাষ্ঠা প্রাপ্ত হইয়াছেন। অতএব আপনাদিগের পবিত্রময় হৃদয় হইতে এই প্রশ্নসার আবিষ্কৃত হইল। এই প্রশ্নসুধা শ্রবণপুটে পান করিয়া আমি কৃতার্থ হইয়াছি। অতএব অবশ্যই আপনাদিগের আজ্ঞা সম্পাদনে সমর্থ হইব। পূর্ব্বকালে যোগীশ্বর মহাদেব নারদকে যে মহাভাগবত নামক পরম গুহ্য পুরাণ কহিয়াছিলেন, বেদব্যাস তপোবলে সেই পুরাণ প্রাপ্ত হইয়া প্রথমতঃ ভক্তিযুক্ত জৈমিনি ঋষির নিকট আদ্যোপান্ত কীর্ত্তন করেন। এক্ষণে আমি সেই পুরাণরত্ন আপনাদিগের নিকট আবিষ্কার করিব; কিন্তু জানিবেন ইহা পরম যত্নেই শ্রোতব্য। এই পুরাণ পাঠে, কি শ্রবণে যে পূণ্যপুঞ্জ জন্মে, মহেশ্বর শত বর্ষেও তাহার সংখ্যা করিতে সমর্থ হন না, আমি কি প্রকারেই বা তাহার পূণ্যসীমা কহিতে পারিব।
সূতের এই বাক্য শুনিয়া মহর্ষিগণ সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; এবং আশ্চার্য্যাম্বিত হইয়া সকলে পুনর্ব্বার কহিতে লাগিলেন, হে মুনিশ্রেষ্ঠ সূত! যে প্রকারে এই মহা পুরাণ ধরাতলে প্রকাশ পাইল, তাহা সবিস্তারে কীর্ত্তন করুন।
সূত গোস্বামী তখন কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, মহর্ষিগণ! শ্রবণ করুন। যিনি বেদ সকলের অদ্বিতীয় তত্ত্বজ্ঞ; যিনি অশেষদ ধর্ম্ম-শাস্ত্রের পারদর্শী, অথচ সদ্বক্তা; যিনি সকল কলাভিজ্ঞ, মহাবুদ্ধিমান; এবং তত্ত্বজ্ঞানী; সেই ধর্ম্মবিৎ ভগবান বেদব্যাস একদা চিন্তা করিলেন, আমি সপ্তদশ মহাপুরাণ প্রস্তুত করিয়া আনন্দিত হইয়াছি; কিন্তু ইহাকে পূর্ণানন্দের উদয় বলা যায় না; (কারণ) তাহা হইলে হৃদয় পরিতৃপ্তি হইত; আর কোন বিষয়ে স্পৃহা থাকিত না। অতএক ভগবতীয় পরম তত্ত্বমাহাত্ম্য যাহাতে বিস্তীর্ণ আছে, পিতার নিকট শুনিয়াছি যার পর পরম মহাপুরাণ আর নাই, আমি কি প্রকারেই বা সেই পুরাণরত্ন সংগ্রহ করিব? মহাযোগী মহেশ্বরও অনায়াসে যাহার পরম তত্ত্ব জানিতে পারেন না, সেই পরমেশ্বরীর পরম তত্ত্ব আমার হৃদয়ে যে উদয় হইবে, ইহা অত্যন্ত অসম্ভব!
(ঋষি) এইরূপ চিন্তা করত নিতান্ত ক্ষুব্ধচেতা হইলেন; আবার বিবেচনা করিলেন, তপস্যা অসাধ্য কিছুই নাই; সর্ব্বশাস্ত্রেই ইহার প্রমাণ করিয়াছে।
এইপ্রকার অবধারণ করত তপস্যায় কৃতনিশ্চয় হইয়া, সেই মহানুভব বেদব্যাস হিমালয় পর্ব্বতে গমন করিয়া দুর্গা-ভক্তি-পরায়ণ হইয়া তপস্যা করিতে লাগিলেন।
বেদব্যাসের প্রতি দৈববাণী
পরাশরসন্তান ব্যাসদেব বহুকাল কঠোর তপস্যা করিলে, ভক্তবৎসলা সর্ব্বাণী সন্তুষ্টা হইয়া অদৃশ্যরূপে আকাশপথে থাকিয়া বলিলেন, হে মহর্ষে! যে স্থানে বেদচতুষ্টয় আছেন, তুমি সেই ব্রহ্মলোকে গমন কর, আমার নির্ব্বিকার পরম তত্ত্ব জানিতে পারিবে। শ্রুতিগণ কর্ত্তৃক স্তবপাঠে আমি দৃষ্টিগোচরা হইয়া তোমার অভিলাষ পরিপূর্ণ করিব।
বেদব্যাস এই প্রকার আকাশ বাণী শুনিয়া সত্বরেই ব্রহ্মলোকে গমন করিলেন। তথায় বিরাজমান বেদচতুষ্টয়্র অগ্রে বিনয়াম্বিত হইয়া সাষ্টাঙ্গ প্রণামপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, হে শ্রুতিগণ! ব্রহ্ম তত্ত্ব কি, তাহা প্রকাশ করিয়া এই শরণাগত শিষ্যের সংশয় ছেদ করত কৃতার্থ করুন।
মহর্ষির ঐপ্রকার বিনয় বাক্যে বেদচতুষ্টয় দয়ার্দ্র-হৃদয় হইয়া প্রত্যেকেই ব্রহ্মতত্ত্ব বলিতে লাগিলেন।
চতুর্ব্বেদের ব্রহ্মতত্ত্বকথন
ঋগ্বেদ বলতেছেন । স্থূল সূক্ষ্ম এই সমস্ত জগত প্রপঞ্চ যাঁহাতে সূক্ষণ রূপে বিলীন থাকে, আরবার ক্ষণকাল মাত্রেই যাঁহার ইচ্ছানুসারে সচরাচর জগৎ হইয়া প্রকাশমান হয়, যিনি স্বয়ং ভগবতী শব্দে কীর্ত্তিতা হন, সেই পরম তত্ত্ব।
যজুর্ব্বেদ বলিতেছেন । নিখল যজ্ঞ এবং যোগদ্বারা যিনি স্তূয়মান হন, এবং যাঁহাতে আমরা ধর্ম্ম বিষয়ে প্রমাণ স্বরূপ হইয়াছি, সেই অদ্বিতীয়া স্বয়ং ভগবতীই পরম ব্রহ্ম তত্ত্ব।
সামবেদ বলিতেছেন । যাহার দ্বারা এই বিশ্ব সংসার ভ্রমবিলষিত হইতেছে, যোগিগণের যোগচিন্তায় যিনি চিন্তনীয়া হন, যাঁহার তেজঃপ্রভাতেই সমস্ত জগৎ প্রকাশ পাইতেছে, সেই জগন্ময়ী দুর্গাই পরং তত্ত্ব।
অথর্ব্ব বেদ কহিতেছেন । ভক্তি দ্বারা যাঁহার অনুগ্রহাশ্রিত লোকেরাই যাঁহাকে বিশ্বেশ্বরী স্বরূপে দেখিতে পায়, যাঁহাকে ভগবতী দুর্গা-শব্দে বলে, সেই পরং ব্রহ্ম তত্ত্ব।
সূত কহিতেছেন শ্রুতিগণের এইপ্রকার বাক্য শ্রবণ করিয়া মহর্ষি ব্যাস ভগবতী দুর্গাকেই পরম ব্রহ্মরূপে নিশ্চয় করিলেন। শ্রুতিগণ পুনর্ব্বার মহর্ষিকে বলিলেন, হে তপোধন! আমরা যে প্রকার বলিলাম, তোমাকে অবিলম্বেই সেইপ্রকার রূপ দর্শন করাওতেছি। এই কথা বলিয়া দেবগণ সকলেই একবাক্য হইয়া সেই চিচানন্দরূপা সর্ব্বদেবময়ী পরমেশ্বরীর স্তব করিতে লাগিলেন।
শ্রুতিগণ কর্ত্তৃক ব্রহ্মময়ী দুর্গার স্তব

হে বিশ্বময়ি দুর্গে! অনিত্য সংসারমধ্যে আপনিই পরমা প্রকৃতি; ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি আপনার শক্তি দ্বারা এই অসীম জগতের সৃষ্টাদিকার্য্য সাধন করিতেছেন। মা! আপনি সকলের বিধাতা হইয়াও নির্বিধাতা; আপনার চরণ সেবা করিয়া হরি দুর্জ্জয় দানবদিগকে অবলীলাক্রমে সংহার করেন; এবং মহাদেব কালকূট হলাহল পান করিয়া আপনার কৃপাবলে জীবিত আছেন, আপনি জগতের অতীত এবং বাক্য মনের অগোচর; আর, পরম পবিত্র; আমাদিগের কি সাধ্য আপনার মহিমা কীর্ত্তন করি! পরম পুরুষ দেহাভিমানী ও অহংভাবাপন্ন হইলে আপনার মায়ায় বশীভূর হন। হে দেবী অম্বিকে! আপনাকে আমরা প্রণাম করি। জগতে স্ত্রী পুরুষ প্রভৃতি যত রূপ ও বস্তু আছে, সে সকল আপনার মূর্ত্তি; কিন্তু আপনি সে সকলেরই অতীতা, সমাধিভাবাপন্ন মনোমাত্রের গোচর পরং ব্রহ্মরূপিণী। হে জননি! যখন আপনার সৃষ্টির ইচ্ছা হয়, তখন শক্তি দ্বারা মূর্ত্তি পরিগ্রহ করেন; যেরূপ জল হইতে করকার উৎপত্তি হয়, সেই রূপ আপনার শক্তি হইতে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের উদয় হয়; অতএব জ্ঞানী ব্যক্তি আপনার মায়াশক্তিকেই ব্রহ্ম বলিয়া নিরূপণ করেন। দেহের মধ্যে যে ষট্‌চক্র আছে, তাহাতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি যে পরম দেবতাগণ বিরাজমান আছেন, তাঁহারাও আপনার শক্তিলাভ ব্যতীত, শবের ন্যায় অকর্ম্মণ্য। হে বিশ্বময়ি! দেবতার একান্ত-বন্দিত যে আপনার পদদ্বয়, তাহার শক্তিতেই নিখিল জগতের সমুদয় কার্য্য সাধিত হয়; অতএব, হে শক্তিরূপিণি দুর্গে দেবি! আমাদিগের প্রতি অনুকম্পা বিতরণ করুন।

ব্রহ্মময়ীর নানাপ্রকার রূপধারণ
ইত্যাদি প্রকারে দেবগণ বহুবিধ স্তব করিলে পর, জগতের আদিভূতা সেই ব্রহ্মসনাতনী প্রসন্না হইয়া বেদানুগৃহীত বেদব্যাসকে আপনার কতকগুলি রূপ দর্শন করাইলেন।
যে দেবী জ্যোতিঃ স্বরূপে সকল প্রাণীতে অবস্থিতি করেন, তিনিই বেদব্যাসের সংশয়চ্ছেদ করিএ স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র আকৃতি ধারণ করিতে লাগিলেন;–প্রথমত দিব্য অস্ত্র দ্বারা বুভূষিত-সহস্র-বাহুযুক্ত; আভা সহস্র সূর্যের; কোটি চন্দ্রের সমান শান্ত জ্যোতির্ম্ময়ী; কখন সিংহ বাহনে, কখন শবাসনে; চতুর্ব্বাহু যুক্তা; নবীন মেঘ মালার ন্যায় নীলকান্তি। কখন দ্বিভুজা; কখন দশভূজা; কখন অষ্টাদশভুজা; কখন শতভুজা; কখন অনন্তবাহুযুক্তা দিব্যরূপধারিণী। কখন বিষ্ণুরূপা, বামভাগে কমলা। কখন কৃষ্ণরূপা, বামে গোপাঙ্গনা। কখন ব্রহ্মরূপা, বামাংশে সাবিত্রী। কখন শিবরূপা, সঙ্গে শিবানী।
এই প্রকারে সেই সর্ব্বরূপিণী ব্রহ্মময়ী অনেকপ্রকার রূপ ধারণ করিয়া বেদব্যাসের সন্দেহ দূর করিলেন।
বেদব্যাসের পুরাণ দর্শন
সূত কহিলেন, হে মহর্ষিগণ! সেই পরাশরসন্তান বেদব্যাস জগদম্বার বিবিধ-বেশ-বিভূষিত, পরম সুন্দর রূপনিকর দর্শন করিয়া, ভগবতী দুর্গাকেই পরমব্রহ্ম্রূপে নিশ্চয় করিলেন; এবং সাক্ষাৎ ব্রহ্মময়ীকে দর্শন করিয়া, মহর্ষি জীবম্মুক্তও হইলেন। অনন্তর সেই অন্তর্যামিনী জগদম্বা, বেদব্যাসের অভিলাষপূরণের জন্য, একটি নির্ম্মল কমলোপরি মনোহর-কেলিযুক্ত রূপধারণ করিলে, বেদব্যাস সেই কমলের সহস্র দলে পরমাক্ষর-যুক্ত, মহাভাগবতনামক পুরাণ দর্শন করিলেন।
বেদব্যাস এইরূপে কৃতকৃত্য হইয়া, পরমদেবীকে নানাবিধ স্তব, এবং সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিয়া, পরমাহ্লাদে স্বাশ্রমে আগমন করিলেন।
অনন্তর তিনি ক্রমে ক্রমে জৈমিনি প্রভৃতি তত্ববুভুৎস্য শিষ্যগণের নিকট সেই পরমাক্ষর-যুক্ত, মহা পুরাণ, পদ্মদলের মধ্যের যদ্রুপ দেখিয়াছিলেন, তদনুরূপ প্রকাশ করিয়াছেন। পরমকরুণিক বেদব্যাস দয়া করিয়া আমাকেও কহিয়াছিলেন; আমি শ্রবণ করিয়াছি, ও তাঁহার কৃপাবলে সমগ্রই স্মৃতিপথে রাখিয়াছি। অদ্যাবধি আপনাদিগের নিকট সেই পুরাণ সংকীর্ত্তন করিব; সহস্র অশ্বমেধ, শত শত বাজপেয়, এই মহাভাগবতের ষোড়ষাংশের তুল্যও নহে। মহাপাতকী পর্য্যন্ত লোক সকলের পরিত্রাণের নিমিত্ত এই মহাপুরাণ ক্ষিতিতলে প্রকাশ হইয়াছে।
প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত।।১।।

 

  1. ০৫. শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ (শ্যামপদ ন্যায়ভূষণ) (১)



    ০৫. শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ (শ্যামপদ ন্যায়ভূষণ)

    মহাপুরাণ, শ্লোকসংখ্যা ১৮০০০ (আঠার হাজার)। মহাভাগবত পুরা - মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ বেদব্যাস প্রণীত, হুগলী জেলার অন্তঃপাতি আঁটপুর নিবাসী দর্শনশাস্ত্রাধ্যাপক শ্রীযুক্ত শ্যামাপদ ন্যায়ভূষণ কর্ত্তৃক বঙ্গভাষায় অনুবাদিত, আনরবাটীনিবাসী শ্রী রামতারক রায় কর্তৃক ১২৮০ সনে প্রকাশিত
    1. মহাভাগবত পুরাণ – ০১ম খণ্ড (১) 

    মহাভাগবত পুরাণ – ০১ম খণ্ড

    ০১. সূত ঋষির নৈমিষারণ্যে গমন । বেদব্যাসের প্রতি দৈববাণী । চতুর্ব্বেদের ব্রহ্মতত্ত্বকথন । শ্রুতিগণ কর্ত্তৃক ব্রহ্মময়ী দুর্গার স্তব । ব্রহ্মময়ীর নানাপ্রকার রূপধারণ । বেদব্যাসের পুরাণ দর্শন

    মহাভাগবত পুরাণ
    প্রথম খণ্ড । প্রথম অধ্যায়
    নারায়ন এবং নরোত্তম নর (১) ও সরস্বতী দেবীকে নমস্কার করিয়া জয় কীর্ত্তন করিবে।
    যাঁহার আরাধারনা করিয়া বিধাতা এই স্থুল সূক্ষ্ম জগতের সৃষ্টি, হরি পালন এবং শিবরূপী দেব সংহার করেন; যিনি যোগিগণের ধ্যেয় বস্তু; মুনিগণ যাঁহাকে মূল প্রকৃতি (২) বলেন, এবং যাঁহার স্তব করিতে করিতে তত্ত্বজ্ঞানী হইয়া নিজ নিজ কৃতার্থতাও সম্পাদন করেন; সেই বিশ্বজননীর চরণে শত শত প্রণাম।
    যিনি স্বর্গ এবং মোক্ষরূপ অতুল্যফলদাত্রী, যিনি নিজ ইচ্ছায় এই জতৎ সংসার সৃষ্টি করিয়া তন্মধ্যে স্বয়ং জন্মলাভ করত শম্ভুকে পতিত্বরূপে বরণ করিয়াছেন, কঠোর তপস্যা দ্বারা শম্ভু যাঁহাকে পত্নী লাভ করিয়া চরণদ্বয় হৃদয়ে ধারণ করিয়াছেন, হে শ্রোতৃবর্গ! সেই দেবী তোমাদিগকে রক্ষা করুন।
    ————-
    ১। “নারায়ণ’ অর্থাৎ, অবিধ্যার সংশ্রবশূণ্য, ব্রহ্ম; “নরোত্তম,” অর্থাৎ, জড়াদি হইতে উৎকৃষ্টতর “নর” অর্থাৎ জীবাত্মা; “সরস্বতী,” ঐ উভয়ের জ্ঞাপিকা বানী “জয়,” অর্থাৎ, যদ্দ্বারা সংসার জয় করা যায়, সেই গ্রন্থ। ভারতকীকায় নীলকন্ঠ।
    ২। অর্থাৎ, সকলের আদি কারণ।
    ————-
    সূত ঋষির নৈমিষারণ্যে গমন
    পরম-ধার্ম্মিক, বেদার্থবেত্তার অগ্রগণ্য সূত গোস্বামী যদৃচ্ছাক্রমে একদা নৈমিষাতণ্য ক্ষেত্রে উপস্থিত হইলে শৌনকাদি ঋষি জিজ্ঞাসা করিলেন, হে মহাত্মন্‌ সূত! আপনি বেদব্যাসের প্রিয় শিষ্য, এবং সর্ব্ব বেদের যথার্থ তত্বজ্ঞ; অতএব সম্প্রতি এরূপ কোন পুরাণ কীর্ত্তন করুন, যাহাতে স্বর্গ ও মোক্ষ, উভয়ই লাভ হয়; এবং যাহাতে বিশ্বজননী দুর্গা দেবীর মাহাত্ম্য, উত্তমরূপে প্রকাশমান আছে, যাহা শ্রবণ করিলে জ্ঞানহীন ব্যক্তিরও দুর্গা দেবীতে দৃঢ়তর ভক্তি উত্তেজিতা হয়।
    সূত কহিলেন, হে মহর্ষিগণ! আপনারা পবিত্রময় ব্রহ্মবংশে জন্মলাভ করিয়া অনুরূপ কার্যানুষ্ঠানে তপস্যার পরা কাষ্ঠা প্রাপ্ত হইয়াছেন। অতএব আপনাদিগের পবিত্রময় হৃদয় হইতে এই প্রশ্নসার আবিষ্কৃত হইল। এই প্রশ্নসুধা শ্রবণপুটে পান করিয়া আমি কৃতার্থ হইয়াছি। অতএব অবশ্যই আপনাদিগের আজ্ঞা সম্পাদনে সমর্থ হইব। পূর্ব্বকালে যোগীশ্বর মহাদেব নারদকে যে মহাভাগবত নামক পরম গুহ্য পুরাণ কহিয়াছিলেন, বেদব্যাস তপোবলে সেই পুরাণ প্রাপ্ত হইয়া প্রথমতঃ ভক্তিযুক্ত জৈমিনি ঋষির নিকট আদ্যোপান্ত কীর্ত্তন করেন। এক্ষণে আমি সেই পুরাণরত্ন আপনাদিগের নিকট আবিষ্কার করিব; কিন্তু জানিবেন ইহা পরম যত্নেই শ্রোতব্য। এই পুরাণ পাঠে, কি শ্রবণে যে পূণ্যপুঞ্জ জন্মে, মহেশ্বর শত বর্ষেও তাহার সংখ্যা করিতে সমর্থ হন না, আমি কি প্রকারেই বা তাহার পূণ্যসীমা কহিতে পারিব।
    সূতের এই বাক্য শুনিয়া মহর্ষিগণ সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; এবং আশ্চার্য্যাম্বিত হইয়া সকলে পুনর্ব্বার কহিতে লাগিলেন, হে মুনিশ্রেষ্ঠ সূত! যে প্রকারে এই মহা পুরাণ ধরাতলে প্রকাশ পাইল, তাহা সবিস্তারে কীর্ত্তন করুন।
    সূত গোস্বামী তখন কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, মহর্ষিগণ! শ্রবণ করুন। যিনি বেদ সকলের অদ্বিতীয় তত্ত্বজ্ঞ; যিনি অশেষদ ধর্ম্ম-শাস্ত্রের পারদর্শী, অথচ সদ্বক্তা; যিনি সকল কলাভিজ্ঞ, মহাবুদ্ধিমান; এবং তত্ত্বজ্ঞানী; সেই ধর্ম্মবিৎ ভগবান বেদব্যাস একদা চিন্তা করিলেন, আমি সপ্তদশ মহাপুরাণ প্রস্তুত করিয়া আনন্দিত হইয়াছি; কিন্তু ইহাকে পূর্ণানন্দের উদয় বলা যায় না; (কারণ) তাহা হইলে হৃদয় পরিতৃপ্তি হইত; আর কোন বিষয়ে স্পৃহা থাকিত না। অতএক ভগবতীয় পরম তত্ত্বমাহাত্ম্য যাহাতে বিস্তীর্ণ আছে, পিতার নিকট শুনিয়াছি যার পর পরম মহাপুরাণ আর নাই, আমি কি প্রকারেই বা সেই পুরাণরত্ন সংগ্রহ করিব? মহাযোগী মহেশ্বরও অনায়াসে যাহার পরম তত্ত্ব জানিতে পারেন না, সেই পরমেশ্বরীর পরম তত্ত্ব আমার হৃদয়ে যে উদয় হইবে, ইহা অত্যন্ত অসম্ভব!
    (ঋষি) এইরূপ চিন্তা করত নিতান্ত ক্ষুব্ধচেতা হইলেন; আবার বিবেচনা করিলেন, তপস্যা অসাধ্য কিছুই নাই; সর্ব্বশাস্ত্রেই ইহার প্রমাণ করিয়াছে।
    এইপ্রকার অবধারণ করত তপস্যায় কৃতনিশ্চয় হইয়া, সেই মহানুভব বেদব্যাস হিমালয় পর্ব্বতে গমন করিয়া দুর্গা-ভক্তি-পরায়ণ হইয়া তপস্যা করিতে লাগিলেন।
    বেদব্যাসের প্রতি দৈববাণী
    পরাশরসন্তান ব্যাসদেব বহুকাল কঠোর তপস্যা করিলে, ভক্তবৎসলা সর্ব্বাণী সন্তুষ্টা হইয়া অদৃশ্যরূপে আকাশপথে থাকিয়া বলিলেন, হে মহর্ষে! যে স্থানে বেদচতুষ্টয় আছেন, তুমি সেই ব্রহ্মলোকে গমন কর, আমার নির্ব্বিকার পরম তত্ত্ব জানিতে পারিবে। শ্রুতিগণ কর্ত্তৃক স্তবপাঠে আমি দৃষ্টিগোচরা হইয়া তোমার অভিলাষ পরিপূর্ণ করিব।
    বেদব্যাস এই প্রকার আকাশ বাণী শুনিয়া সত্বরেই ব্রহ্মলোকে গমন করিলেন। তথায় বিরাজমান বেদচতুষ্টয়্র অগ্রে বিনয়াম্বিত হইয়া সাষ্টাঙ্গ প্রণামপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, হে শ্রুতিগণ! ব্রহ্ম তত্ত্ব কি, তাহা প্রকাশ করিয়া এই শরণাগত শিষ্যের সংশয় ছেদ করত কৃতার্থ করুন।
    মহর্ষির ঐপ্রকার বিনয় বাক্যে বেদচতুষ্টয় দয়ার্দ্র-হৃদয় হইয়া প্রত্যেকেই ব্রহ্মতত্ত্ব বলিতে লাগিলেন।
    চতুর্ব্বেদের ব্রহ্মতত্ত্বকথন
    ঋগ্বেদ বলতেছেন । স্থূল সূক্ষ্ম এই সমস্ত জগত প্রপঞ্চ যাঁহাতে সূক্ষণ রূপে বিলীন থাকে, আরবার ক্ষণকাল মাত্রেই যাঁহার ইচ্ছানুসারে সচরাচর জগৎ হইয়া প্রকাশমান হয়, যিনি স্বয়ং ভগবতী শব্দে কীর্ত্তিতা হন, সেই পরম তত্ত্ব।
    যজুর্ব্বেদ বলিতেছেন । নিখল যজ্ঞ এবং যোগদ্বারা যিনি স্তূয়মান হন, এবং যাঁহাতে আমরা ধর্ম্ম বিষয়ে প্রমাণ স্বরূপ হইয়াছি, সেই অদ্বিতীয়া স্বয়ং ভগবতীই পরম ব্রহ্ম তত্ত্ব।
    সামবেদ বলিতেছেন । যাহার দ্বারা এই বিশ্ব সংসার ভ্রমবিলষিত হইতেছে, যোগিগণের যোগচিন্তায় যিনি চিন্তনীয়া হন, যাঁহার তেজঃপ্রভাতেই সমস্ত জগৎ প্রকাশ পাইতেছে, সেই জগন্ময়ী দুর্গাই পরং তত্ত্ব।
    অথর্ব্ব বেদ কহিতেছেন । ভক্তি দ্বারা যাঁহার অনুগ্রহাশ্রিত লোকেরাই যাঁহাকে বিশ্বেশ্বরী স্বরূপে দেখিতে পায়, যাঁহাকে ভগবতী দুর্গা-শব্দে বলে, সেই পরং ব্রহ্ম তত্ত্ব।
    সূত কহিতেছেন শ্রুতিগণের এইপ্রকার বাক্য শ্রবণ করিয়া মহর্ষি ব্যাস ভগবতী দুর্গাকেই পরম ব্রহ্মরূপে নিশ্চয় করিলেন। শ্রুতিগণ পুনর্ব্বার মহর্ষিকে বলিলেন, হে তপোধন! আমরা যে প্রকার বলিলাম, তোমাকে অবিলম্বেই সেইপ্রকার রূপ দর্শন করাওতেছি। এই কথা বলিয়া দেবগণ সকলেই একবাক্য হইয়া সেই চিচানন্দরূপা সর্ব্বদেবময়ী পরমেশ্বরীর স্তব করিতে লাগিলেন।
    শ্রুতিগণ কর্ত্তৃক ব্রহ্মময়ী দুর্গার স্তব
    হে বিশ্বময়ি দুর্গে! অনিত্য সংসারমধ্যে আপনিই পরমা প্রকৃতি; ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি আপনার শক্তি দ্বারা এই অসীম জগতের সৃষ্টাদিকার্য্য সাধন করিতেছেন। মা! আপনি সকলের বিধাতা হইয়াও নির্বিধাতা; আপনার চরণ সেবা করিয়া হরি দুর্জ্জয় দানবদিগকে অবলীলাক্রমে সংহার করেন; এবং মহাদেব কালকূট হলাহল পান করিয়া আপনার কৃপাবলে জীবিত আছেন, আপনি জগতের অতীত এবং বাক্য মনের অগোচর; আর, পরম পবিত্র; আমাদিগের কি সাধ্য আপনার মহিমা কীর্ত্তন করি! পরম পুরুষ দেহাভিমানী ও অহংভাবাপন্ন হইলে আপনার মায়ায় বশীভূর হন। হে দেবী অম্বিকে! আপনাকে আমরা প্রণাম করি। জগতে স্ত্রী পুরুষ প্রভৃতি যত রূপ ও বস্তু আছে, সে সকল আপনার মূর্ত্তি; কিন্তু আপনি সে সকলেরই অতীতা, সমাধিভাবাপন্ন মনোমাত্রের গোচর পরং ব্রহ্মরূপিণী। হে জননি! যখন আপনার সৃষ্টির ইচ্ছা হয়, তখন শক্তি দ্বারা মূর্ত্তি পরিগ্রহ করেন; যেরূপ জল হইতে করকার উৎপত্তি হয়, সেই রূপ আপনার শক্তি হইতে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের উদয় হয়; অতএব জ্ঞানী ব্যক্তি আপনার মায়াশক্তিকেই ব্রহ্ম বলিয়া নিরূপণ করেন। দেহের মধ্যে যে ষট্‌চক্র আছে, তাহাতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি যে পরম দেবতাগণ বিরাজমান আছেন, তাঁহারাও আপনার শক্তিলাভ ব্যতীত, শবের ন্যায় অকর্ম্মণ্য। হে বিশ্বময়ি! দেবতার একান্ত-বন্দিত যে আপনার পদদ্বয়, তাহার শক্তিতেই নিখিল জগতের সমুদয় কার্য্য সাধিত হয়; অতএব, হে শক্তিরূপিণি দুর্গে দেবি! আমাদিগের প্রতি অনুকম্পা বিতরণ করুন।
    ব্রহ্মময়ীর নানাপ্রকার রূপধারণ
    ইত্যাদি প্রকারে দেবগণ বহুবিধ স্তব করিলে পর, জগতের আদিভূতা সেই ব্রহ্মসনাতনী প্রসন্না হইয়া বেদানুগৃহীত বেদব্যাসকে আপনার কতকগুলি রূপ দর্শন করাইলেন।
    যে দেবী জ্যোতিঃ স্বরূপে সকল প্রাণীতে অবস্থিতি করেন, তিনিই বেদব্যাসের সংশয়চ্ছেদ করিএ স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র আকৃতি ধারণ করিতে লাগিলেন;–প্রথমত দিব্য অস্ত্র দ্বারা বুভূষিত-সহস্র-বাহুযুক্ত; আভা সহস্র সূর্যের; কোটি চন্দ্রের সমান শান্ত জ্যোতির্ম্ময়ী; কখন সিংহ বাহনে, কখন শবাসনে; চতুর্ব্বাহু যুক্তা; নবীন মেঘ মালার ন্যায় নীলকান্তি। কখন দ্বিভুজা; কখন দশভূজা; কখন অষ্টাদশভুজা; কখন শতভুজা; কখন অনন্তবাহুযুক্তা দিব্যরূপধারিণী। কখন বিষ্ণুরূপা, বামভাগে কমলা। কখন কৃষ্ণরূপা, বামে গোপাঙ্গনা। কখন ব্রহ্মরূপা, বামাংশে সাবিত্রী। কখন শিবরূপা, সঙ্গে শিবানী।
    এই প্রকারে সেই সর্ব্বরূপিণী ব্রহ্মময়ী অনেকপ্রকার রূপ ধারণ করিয়া বেদব্যাসের সন্দেহ দূর করিলেন।
    বেদব্যাসের পুরাণ দর্শন
    সূত কহিলেন, হে মহর্ষিগণ! সেই পরাশরসন্তান বেদব্যাস জগদম্বার বিবিধ-বেশ-বিভূষিত, পরম সুন্দর রূপনিকর দর্শন করিয়া, ভগবতী দুর্গাকেই পরমব্রহ্ম্রূপে নিশ্চয় করিলেন; এবং সাক্ষাৎ ব্রহ্মময়ীকে দর্শন করিয়া, মহর্ষি জীবম্মুক্তও হইলেন। অনন্তর সেই অন্তর্যামিনী জগদম্বা, বেদব্যাসের অভিলাষপূরণের জন্য, একটি নির্ম্মল কমলোপরি মনোহর-কেলিযুক্ত রূপধারণ করিলে, বেদব্যাস সেই কমলের সহস্র দলে পরমাক্ষর-যুক্ত, মহাভাগবতনামক পুরাণ দর্শন করিলেন।
    বেদব্যাস এইরূপে কৃতকৃত্য হইয়া, পরমদেবীকে নানাবিধ স্তব, এবং সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিয়া, পরমাহ্লাদে স্বাশ্রমে আগমন করিলেন।
    অনন্তর তিনি ক্রমে ক্রমে জৈমিনি প্রভৃতি তত্ববুভুৎস্য শিষ্যগণের নিকট সেই পরমাক্ষর-যুক্ত, মহা পুরাণ, পদ্মদলের মধ্যের যদ্রুপ দেখিয়াছিলেন, তদনুরূপ প্রকাশ করিয়াছেন। পরমকরুণিক বেদব্যাস দয়া করিয়া আমাকেও কহিয়াছিলেন; আমি শ্রবণ করিয়াছি, ও তাঁহার কৃপাবলে সমগ্রই স্মৃতিপথে রাখিয়াছি। অদ্যাবধি আপনাদিগের নিকট সেই পুরাণ সংকীর্ত্তন করিব; সহস্র অশ্বমেধ, শত শত বাজপেয়, এই মহাভাগবতের ষোড়ষাংশের তুল্যও নহে। মহাপাতকী পর্য্যন্ত লোক সকলের পরিত্রাণের নিমিত্ত এই মহাপুরাণ ক্ষিতিতলে প্রকাশ হইয়াছে।
    প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত।।১।।





     





No comments:

Post a Comment